মোঃ আরিফ উল্লাহঃ
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটালাইজেশনের দিকে ছুটে চলেছে আমাদের লাল সবুজের বাংলাদেশ, বর্তমান সরকার উন্নয়নে অতীতের সকল রেকর্ড পিছনে ফেলে অন্ন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আধুনিক চাহিদার কথা মাথায় রেখে নির্মিত হচ্ছে বহুতল ভবন কিন্তু দুর্ঘটনা মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সকে কতোখানি আধুনিকায়ন করতে পেরেছে সরকার? বিস্তৃত এলাকা নিয়ে মার্কেট, শিল্প কাঁরখানা গড়ে উঠছে কিন্তু দূর্ঘটনা মোকাবেলায় নেয়া হচ্ছে না নূন্যতম ব্যবস্থা। তাই কিছু দিন পর পর একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে কিন্তু প্রতিবারই আমাদের ভূমিকা নিতান্তই অসহায় মেছো বাঘের মত, না পারি হুংকার দিতে, না পারি আত্মরক্ষা করতে। অগ্নিকান্ড হোক বা অন্য কোনো দুর্ঘটনা মোকাবেলায় আমাদের “ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সকে” হিমশিম খেতে হয়। আমরা কখনোই এই বাহিনীর আত্মত্যাগ ও কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবো না, কিন্তু এই বিষয়টি তিক্ত হলেও সত্য যে বড় আকারের দুর্ঘটনা মোকাবেলায় যে সকল আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োজন তাতে আমাদের অনেক ঘাটতি রয়েছে। এই প্রযুক্তিগত কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে এই বাহিনীর এবং সরকারের ভালো কাজগুলো আড়ালে পড়ে যাচ্ছে।
প্রতি বছর হাজার হাজার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে চলেছে সেই সাথে রাতারাতি পথে বসে যাচ্ছে হাজারো পরিবার, ভেঙ্গে যাচ্ছে কয়েক যুগের লালিত স্বপ্ন, কেউ হারায় তার মা-বাবাকে, কেউ হারায় তার স্বামী, মা-বাবা হারায় তার সন্তান আর দেশ হারায় অমূল্য রতন। ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যায় ২০২২ সালে প্রায় ২৪ হাজার ১০২ টি অগ্নিকান্ডের ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ যা ২০২১ সালের তুলনায় ৫ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালে অগ্নিকান্ডে মোট ৯৮ জন মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে, যেখানে ১৩ জন ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন স্থরের সদস্য রয়েছে।
আমাদের দেশে অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণগুলো হলো, পূর্বে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার, ভবন তৈরিতে আইন না মানা, বিভিন্ন শিল্প কারখানায় গ্যাস ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ব্যবহারের নিয়ম নীতির তাওয়াক্কা না করা, অনিরাপদ রান্নাঘর, সিগারেট ও মশার কয়েল ব্যবহারে অসতর্কতা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকা ও থাকলেও প্রশিক্ষণের অভাবে ব্যবহার করতে না পারা। দুর্ঘটনাস্থল থেকে বাহির হওয়ার বিকল্প রাস্তা না থাকা ইত্যাদি। অন্যদিকে সরু রাস্তা, বাড়ির মালিক বা তত্বাবধায়কের ভুল সিদ্ধান্ত বা গাফেলতি, আশেপাশে জ্বলাশয় বা পানির ব্যবস্থা না থাকা, অতি উৎসাহী মানুষের ভিড় ও কাজে সমন্বয়ের অভাবে আগুণ নিভাতে সময়ক্ষেপণ হয়, যার দরুন আগুণ আশপাশের ছড়িয়ে পরে এবং ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যায়। বিগত কয়েক বছর ধরে আগুণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ৩শ থেকে ৩৩০ কোটির আশেপাশে লক্ষ করা যাচ্ছে, কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অগ্নিকান্ডে ক্ষতির পরিমান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০শ কোটি যা দেশের অর্থনিতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, সেইসাথে বেকার হয়েছে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি কর্মজিবী মানুষ।

আমরা যদি ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের বড় আকারের দুর্ঘটনা ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা গুলোর দিকে লক্ষ করি তাহলে এর চিত্র কিছুটা এমন, ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ৪টি বড় আকারের দুর্ঘটনায় মোট নিহত প্রায় ১৬৪ জন যার মধ্যে আশুলিয়ায় স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধ্বসের কারণে ৬৪ জনের প্রাণহানি হয়। ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ৪টি দুর্ঘটনার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ যেখানে প্রায় ১৩৬টি প্রাণ অকালে ঝরে যায়, এখানে ২০০৬ সালে কে টি এস টেক্সটাইল মিলে (চট্রগ্রাম) আগুণ লাগার ঘটনার কথা না বললে নয়, এ ঘটনায় প্রায় ৬৫জনের মৃত্যু ঘটে। ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩টি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যেখানে প্রায় ১২৫০ টি প্রাণহানি হয়, ২০১৩ সালের সেই রানা প্লাজা নামক মৃত্যুপুরীর কথা মনে পরলে আজো আমাদের সকলের চোখ দিয়ে অনর্গল পানি চলে আসে। এতে প্রায় ১১৩৮ জন মারা যায়, এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার সম্মুখীন বাংলার মানুষ ইতিপূর্বে কখনো হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় ৬টি দুর্ঘটনা ঘটে যেখানে ১২২ জনের প্রাণহানি ঘটে, এসময়ে পুরান ঢাকার একটি এলাকায় প্রাণঘাতী অগ্নিকান্ডে প্রায় ৭০ জনের প্রাণহানি হয়। ২০২১ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ১৫৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
২০০০ সাল থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত কমপক্ষে ২১ অতিমারাত্নক দুর্ঘটনা ঘটে যেখানে প্রায় ১৮২৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
আমরা প্রতি বছর এমন দুর্ঘটনার চিত্র ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পেয়ে থাকি। গণমাধ্যমগুলো প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে আমাদেরকে সামনে উপস্থাপন করে, আমরা নিজেরা অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ করি, কিছু ঘটনা খোদ আমাদের সাথেই ঘটে কিন্তু কোনো কিছুই যেন আমাদেরকে সচেতন করতে পারছে না।
এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় আলোচনা করতে গেলে যে বিষয়সমূহ সামনে আসে তার মধ্যে অন্যতম হলো এই খাতে বার্ষিক বরাদ্ধ ঘাটতি, সরকারের উচিৎ এই খাতে বাজেট বৃদ্ধি করা, আমার যদি টাকা না থাকে তাহলে আমি কিভাবে আধুনিকায়নের দিকে অগ্রসর হবো? তারপর যে বিষয় টি নিয়ে কথা বলা দরকার তা হলো এই বাহিনীর জনবল, দিন দিন আমাদের ফায়ার ষ্টেশনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু বাড়ছেনা এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা, তাই যথাযথ জনবল নিশ্চিত করা খুব প্রয়োজন। আমাদের কমার্শিয়াল চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের নিয়ম মাফিক ইমারত নির্মান করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর পর এলাকা ভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেম চালু করতে হবে। এছাড়াও শিল্প কাঁরখানা, শপিং কমপ্লেক্স বা বড় বড় মার্কেটের কর্মিদের অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে হবে, দাহ্য পদার্থ কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয় সে বিষয়ে পরিপূর্ন ধারনা দিতে হবে, বিশেষ করে অগ্নি প্রতিরোধ পরিকল্পনা এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরিয়ে নেয়ার কৌশল বিষয়ে ধারনা প্রদান করতে হবে। উন্নত দেশের মতো বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সে ফাইয়ার ফাইটিং রোবট, এরেন্স ফাইয়ার ফাইটিং ড্রোন, ফাইয়ার এক্সটিংগুইশার বল, স্কাই সেভার, এল ইউ এফ ৬০ ফিয়ার ফাইটিং মেশিন ও স্মুক ডিটেক্টর সহ আরো অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে যা আমাদের ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা খুবই কম সময়ে বাডিয়ে দিতে সক্ষম। আমরা যদি পদ্মা সেতুর মতো এতো বিশাল প্রকল্প সফলতার সাথে সম্পন্ন করতে পারি তাহলে এই আধুনিক সরঞ্জাম আমাদের ফায়ার সার্ভিসে যুক্ত করা তেমুন আহামরি কোন কিছু নয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা দেখি আমাদের পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও উন্নয়ন কর্পোরেশনগুলো তাদের দায় এড়াতে বলে বেড়ায় যে, তারা উক্ত ভবন/মার্কেট টি অনেক আগেই ঝুকিপূর্ন বলে ঘোষনা করেছে, এই বলে তারা নিজের সকল দ্বায়িত কর্তব্য থেকে পাশ কেটে যায়? এ সকল প্রতিষ্ঠানকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালনে সরকারের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেন এই প্রতিষ্ঠাঙ্গোলো আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যথায় বাংলার বুকে আগুনের লাল শিখা জ্বলতেই থাকবে।

মোঃ আরিফ উল্লাহ
ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প সমন্বয়কারী,
কোস্ট ফাউন্ডেশন।
Email: arifcbiu@gmail.com